একবার রনিদের ক্লাসে স্যার জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কলুর বলদ মানে কী? বাগধারা বল।’ শুনে বেশ চিন্তায় পড়ে গেল রনি। বলদ সে খুব ভালো করে চেনে। কোনো কিছু না বুঝলে তারা প্রায়ই বন্ধুকে খোঁচা মেরে বলে, ‘সহজ জিনিসটা বুঝলি না? ব্যাটা বলদ!’ কিন্তু কলুটা কী তা মাথায় এল না। শেষে স্যারই বললেন, ‘কলুর বলদ মানে হলো একটানা খাটুনি করে যে। বাসায় গিয়ে কলুর বলদের মতো বাগধারা পড়বি।’
রনি ঠিক করল, পরীক্ষা শেষে গ্রামে গিয়ে স্বচক্ষে কলুর বলদ দেখে আসবে। আমি কিন্তু স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষা শেষে ছুটতাম গ্রামের বাড়িতে—রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার তিস্তাপারের কোলকোন্দ গ্রামে। গ্রামের বাড়িতে খাঁটি সরষে তেলের মাড়াই ছিল। যিনি ঘানি থেকে তেল তৈরি করতেন, তাঁকে তেলি চাচা বলে ডাকতাম আমরা। টিভি বিজ্ঞাপনের ঘানি নয়, একেবারে আসল ঘানি। গরু দিয়ে তেল মাড়াই হতো সেখানে। দূরদূরান্তের মানুষ খাঁটি সরষের তেলের জন্য আসত চাচার কাছে।
একটি বলদ গরু দিয়ে সরষের তেল মাড়াই অনেক পুরোনো পদ্ধতি। কালের বিবর্তনে তা হারিয়ে যেতে বসেছে। ঘানিশিল্প গ্রামেও এখন খুব একটা দেখা যায় না। তবে কোনো কোনো শহরে ইদানীং আবার দেখা যাচ্ছে। রংপুর শহর থেকে বুড়িরহাট যাওয়ার পথে কদমতলা এলাকায় এমনই একটি দৃশ্য চোখে পড়ল। একটি বলদ গরুর কাঁধে ‘জোয়াল’। জোয়াল আসলে একধরনের কাঠের দণ্ড, যা গরুর কাঁধে শক্তভাবে বসানো থাকে। তাই কাঁধ থেকে গরুর আলাদা হওয়ার কোনো উপায় নেই। জোয়ালের ওপর আনুমানিক ৩৫ কেজি ওজনের ইট অথবা পাথর চাপিয়ে দেওয়া হয়। গরুর চোখে বেঁধে দেওয়া হয় কালো কাপড়, গরুটি ঘুরে চক্রাকারে। আর ফোঁটা ফোঁটা তেল পড়ে। তেল তৈরির জন্য স্থানীয় প্রযুক্তিতে গাছের গুঁড়ির মাঝখানে গর্ত করে সেখানে একটি কাঠের দণ্ড দেওয়া আছে। আর এই গর্তের মধ্যে সরষের দানা ভিজিয়ে ভরা হয়। গরু ঘোরে আর ঘোরে। ঘুরে ঘুরে পিষে দেয় সরষের দানাগুলো। নিচে চিকন একটি ছিদ্র রয়েছে। টিনের তৈরি একটি নল দিয়ে টপ টপ করে তেলের ফোঁটা পড়ছে পাত্রে।
গরুর চোখে কালো কাপড় কেন, তা নিয়ে তোমরা প্রশ্ন করতে পারো। আসলে গরু যাতে আশপাশের কিছু দেখতে না পারে, সে জন্যই তার চোখে কালো কাপড় বাঁধা হয়। ঘুরতে ঘুরতে হয়তো সবুজ ঘাসের দিকে মনোযোগ চলে যাবে গরুর কিংবা বন্ধুর হাম্বা ডাক শুনে ইচ্ছে করবে মাঠে ছোটার। কে চায় ঘুরে ঘুরে সরষে ভাঙাতে? কিন্তু বেচারা গরু এসবের কিছু ভাবতেই পারে না। অন্ধকারে অবিরাম ঘোরে সে। ছুটে যাওয়ার কেনো উপায় নেই। কর্তার (চালক) মর্জি হলে হয়তোবা গরুটির জন্য কিছুটা বিশ্রামের ব্যবস্থা হয়, কখনো হয় না। এভাবেই দিনের পর দিন একটানা খাটছে গরুটি। তার খাটুনির বিনিময়ে ফোঁটা ফোঁটা করে তেল পড়ে। খাঁটি সরষের তেল। ঘানির তেল নামে যাকে চিনি আমরা।
তেল মাড়াইয়ের এই প্রাচীন পদ্ধতিটা নিষ্ঠুর বা কঠিন হলেও সবার কাছে এর চাহিদা দারুণ। ঘানিভাঙা তেলের ঘ্রাণ, স্বাদ খুব সহজে সবাইকে আকৃষ্ট করে। গায়ে মাখা, তরকারিতে ব্যবহার, যেকোনো ধরনের ভর্তা, মুড়ি মাখানো ও সালাদে এই তেল অতুলনীয়। তা ছাড়া সর্দি-কাশিরও বড় ওষুধ এই সরিষার তেল।
এক মিনিটে তেলের ফোঁটা পড়ে ৩৫ বার। যার ওজন মাত্র ৫০ গ্রাম। ছয় কেজি সরষে ভরে প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা সময় নিয়ে দুই লিটার সরষে তেল পাওয়া যায়। প্রতি লিটারের মূল্য ২৮০ টাকা। এক কেজি সরিষার দাম ১২ টাকা। এমনি করে প্রতিদিন একটি ঘানি থেকে চার লিটার পর্যন্তু তেল পাওয়া যায়। তাহলে এত দামের তেল মাড়ানোর জন্য পরিশ্রম করা বলদ গরুটির বেতন কত হওয়া উচিত? তোমরাই নাহয় অঙ্ক করে বের করে নিয়ো।
ছবি: মঈনুল ইসলাম